Monday, October 22, 2012

মহান হবার ফর্মুলা আবিষ্কারের গল্প... (প্রথম পর্ব: নতুন পৃথিবী)


আমার দিন-কাল ভালই কাটছিল। দুপুর পর্যন্ত ক্লাস, বিকেল পর্যন্ত অফিস, সন্ধ্যা পর্যন্ত ডেটিং, রাত পর্যন্ত আড্ডা আর মাঝ-রাত পর্যন্ত মুঠোফোনে প্রেমালাপ। পৃথিবীর সকল সমস্যা এবং তার সমাধান, এই ছকের মধ্যেই বেধে ফেলা যেত। ফোনে প্রেমালাপ আর কত সময়ই করা যায়! ভালবাসি... খুব ভালবাসি... এই প্রকার আলাপচারীতার দৈর্ঘ্য কখনোই ৩০ মিনিট ছাড়িয়ে যায় না। বাকিটা সময় দৈনন্দিন হাড়ি-পাতিলের সংঘর্ষের শব্দাবলীই তখন হয়ে ওঠে প্রেম!
হাড়ি-কড়াইয়ের এই টুংটাং শব্দের মাঝেই শুনতে পেলাম, আমার প্রেমিকা নাকি ব্লগ পড়া ধরেছে। যাই হোক, এটাকে কখনোই আমার সেই ব্যক্তিগত রুটিনের সাথে সাংঘর্ষিক মনে হয় নি, তাই এটা নিয়ে ভাবার কথাও ভাবতে হয়নি কখনও। তবুও প্রেমিকার কাছে ক্রেডিট নেবার লোভটা ছাড়ার মত মহামানবীয় গুন আমার নেই। ফলাফল, প্রেমিকার বিস্ময় মাখা সোৎসাহের উক্তি -
" আয়হায়!!!! তুমি ব্লগ লিখ!!!!!!!!!! দাও তো লিংকটা দাও তো...."
" এহ! হে! তোমার তো ম্যাক্সিমামই ইংলিশ ...."
" ব্লগ গুলাতে কেউ ইংলিশ লেখা পড়ে না..... "
" তুমি তো ভালোই লিখ, বাংলায় লিখ না.... "
" ব্লগে একটা একাউন্ট খুল না...."
" দরকার হলে আমি ট্রান্সলেট করে দিলাম....."
" একটা লিংক দিচ্ছি, পড়, বল কেমন লাগে...."

" ঐ লিখাটা কেমন?..... "
ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি......
আর এভাবেই বাংলা ব্লগের জগতে আমার পদার্পণ। কিন্তু এতেও আমার রুটিন বদলায় না।
তো আমার এমন নিরুপদ্রব জীবনে হুট করে আগমন এক বড় ভাইয়ের। সে নাকি আমার ভার্সিটির বড় ভাই! তাও আবার আমারই ডিপার্টমেন্ট!!!! ৯৮ হতে ২০০৭, প্রায় সবাইকেই চিনি। যাদের একটু নাম আছে তাদের তো চিনিই। ২০১১র মাঝামাঝি এসে যদি হুট করে নতুনভাবে কোন নাম করা বড় ভাইকে চেনা লাগে তবে অহমে একটু আঘাত লাগে বৈকি। আর তাও যদি পরিচয় পর্যন্তই হত...
" ভাইয়া কি লিখেছে দেখেছ?..."
" ভাইয়ার ঐ পোস্টটা না খুব ভাল হয়েছে..."
" জানো, ভাইয়াকে না কল্লা নামানোর হুমকি দিয়েছে ঐ পোস্টে..."
" ভাইয়া না নতুন একটা নোট শেয়ার দিয়েছে... হুজুরদের পুরা বাঁশ দিয়েছে..."
" ঐদিন ভাইয়ার সাথে চ্যাট করলাম...."
" জানো, ভাইয়ারা না নতুন একটা পেজ খুলেছে, ভাইয়ার পেজ না, ফ্রেন্ডের, কিন্তু ভাইয়া সাপোর্ট দিয়েছে, আর ভাইয়া সাপোর্ট দিলে সেই পেজের কি হয় জানোই তো..."
... ... ... ... ... ...
" এই তুমি তো ঐ পেজে লিখতে পার, লিখ না কেন? আমাদের অনেক সাপোর্ট দরকার, যত বেশি মানুষ লিখে ততই লাভ...."
" এই লিখ না... ঐ তোমাকে কি বলছি বুঝছ? লিখ...."
এইভাবে ভাইয়া আমার অনলাইন জীবনে শক্ত খুঁটি গেড়ে বসে গেল, যা উপড়ে তোলা সংগত কারণেই সম্ভব না। আর প্রেমিকার মন রক্ষার্থে, সকলেরই জানা টক অব দা টাউন কথা গুলাই বারবার ভাইয়ার আঙ্গুল-নিঃসৃত পোস্ট থেকে আবার পড়া লাগছে, মতামত দিতে হচ্ছে, লাইক দিতে হচ্ছে, কমেন্ট করতে হচ্ছে... নিয়ম করে, দু'বেলা। মহা বিরক্তিকর ব্যাপার...
ভাইয়ার সাঙ্গোপাঙ্গ, সহযাত্রীও কম নয়। তারা সকলেই ঘরে বসে, ১৫" স্ক্রিনে আটক অনলাইন জগতে বিপ্লব ঘটাতে চান, সমাজ বদলে দিতে চান, পারলে পৃথিবীও বদলে দেন। কর্ত্রীর ইচ্ছায় কর্ম, ইহাই প্রেমিকের ধর্ম। তাই আমিও যোগ দিতে বাধ্য হই এই অস্তিত্ব-বিহীন সংগ্রামে।
প্রথমে বিরক্তিকর লাগলেও পরে একসময় নিজের চেনা জানা গণ্ডির বাইরে গিয়ে প্রেমিকার মতই ভাবতে শুরু করলাম। "তাও তো ওরা কিছু একটা করছে, আমি নিজের অবাঞ্ছিত রোম না উপরে, ওদের সমর্থন দিলেও তো পারি!!!" এভাবে ভাবতে শুরু করার সাথে সাথে ১৫ ইঞ্চির এই রঙ্গমঞ্চটা বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠল। এই মঞ্চের সবখানেই কেমন একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। আমিও তাদের একজন ভাবতে ভালোই লাগছিল। প্রেমিক-প্রেমিকা দুইজন একসাথে পোস্ট পড়ি, লাইক দেই, কমেন্ট করি, আলোচনা করি... ভালোই লাগে।
এই ফাঁকে যে আমাদের প্রেমময় জীবনটাও একটু একটু বদলে যাচ্ছে সেটা আর খেয়াল করে দেখিনি...

No comments:

Post a Comment