Skip to main content

দুঃসময় বা দুঃস্বপ্নের সময়...

কেন যেন মনে হচ্ছে দুঃস্বপ্ন দেখছি, আর প্রচন্ড অসহায় হয়ে চাচ্ছি, কেউ আমার ঘুমটা এক ঝটকায় ভেঙ্গে দিক।

দুঃস্বপ্নের শুরু মায়ের অসুস্থতা দিয়ে। এখান ওখান করে শেষ পর্যন্ত কুর্মিটোলা হাসপাতালে পৌছালাম, ইমারজেন্সি-তে ওদের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতেই মেইল এল, আম্মার COVID-19 পজিটিভ। সব ভয় ভুলে, চলে গেলাম রোগি ভরা ওয়ার্ডে, বেডে শুইয়ে দিলাম, ডায়ালাইসিস করে দিলাম। চলে আসার সময়, একবার মনে হল, এর পর আর দেখা হবে না।

দু'দিন পর, ICU তে যায়গা পাওয়ায়, একটু নিশ্চিন্তে অফিসের একটা মিটিং এ জয়েন করলাম। মাঝামাঝি সময় ফোন এল, আম্মু সব চিকিৎসার বাইরে চলে গেছে, আম্মুকে নিয়ে আসতে হবে। সেদিন সেপ্টেম্বরের ৩০, ২০২০। ঈদের আর দুদিন বাকি। পরদিন বানানি কবরস্থানে মাটি চাপা দিলাম। সেই সময় প্রচন্ড বৃষ্টি, আগের দিন থেকেই স্বাভাবিকভাবেই চলছিলাম, কিন্তু কেন যেন এখন আর পারলাম না, সকল আত্মসংযমের বাধ ভেঙ্গে চুরে, বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে কান্না এল। 
বৃষ্টির পানি, মুখের মাস্ক, পিপিই সব মিলে সেই চোখের পানি লুকিয়েই ছিল হয়তো, খেয়াল করা হয়নি। বা সেই অবস্থায় ও ছিলাম না।

 এর পর ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন, বাসার সবার। এর মাঝেই বাবার পাতলা পায়খানা আর বমি। মামা বললেন, ভয়ের কিছু না, দাতে ব্যাথার যে ওষুধ, সেটার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়।  বাবা বেশ দুর্বল, খাওয়া কমে গেল, জীবনে যেটা দেখি নাই, ভাত নষ্ট করছে প্রতি বেলা। আমারও সেই সময় অল্প জ্বর দিয়ে কাশি হয়েছে। সেই সাথে, কোন রকম গন্ধ নেবার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু, বাবার ভাত নষ্ট করা দেখে, মনের আশংকা-কে প্রশমিত করি নিজেকে এই বলে, যে আর ২-৪ দিন পরেই কোয়ারেন্টিন শেষ, সবার টেস্ট করিয়ে ফেলব, পিজির ফিভার ক্লিনিকে বুকিং দিতে হবে।

শুক্রবার কয়ারেন্টিন শেষ হবে, বের হবার জন্য প্ল্যান করছি, এমন সময় আব্বা বলল, "আমার অক্সিজেনটা মাইপা দে তো"। ভেতরটা কেপে উঠলো সাথে সাথেই। মেপে দেখি, আসলেই খারাপ। মামাকে জানালাম, ৪-৫টা টেস্ট করতে বললেন। ২ টার রেজাল্ট দেরিতে পাব, জাতীয় শোক দিবসের বন্ধের কারনে, বাকিগুলা পেলাম, নিউমোনিয়া। 

ওষুধ আর অক্সিজেন চলছে, দুদিন পর পেলাম বাকি দুটা রিপোর্ট। সেই সাথে COVID-19 পজিটিভ। এবার ভর্তি পিজিতে, আগস্টের ১৭, ২০২০ । প্রথমদিন অক্সিজেন লাগলো, পরদিন থেকে অক্সিজেন ছাড়াই সুস্থ। আব্বার দেখাদেখি, পাশের বেডের সিরিয়াস রোগিও অনেক মনের বল পেয়েছেন,  এখন উনিও অনেক সুস্থ। শনিবার ডাক্তার রিলিজের কথা পাড়লেন। এভাবে চললে রিলিজ দিয়ে দিবেন। আমাদের হিসেব, দিলেও আমরা আরও ২ দিন থাকবো, কোন রিস্ক নিব না।

রবিবার আগস্ট ২৪, ২০২০, খাবার দিতে আসার আগেও ছোট ভাইয়ের কাছে সুনলাম, ডাক্তার রিলিজ দেবার জন্য রেডি। বৌ এর সাতজে প্ল্যান করলাম, যে আব্বা এলে, আমার সাথেই রেখে দিব। ছোট ভাইয়ের সাথে থাকার দরকার নাই। একটু পর শুনলাম, মাথা ব্যাথা, বমি করে কমেছে, ঘুমাচ্ছে। হাস্পাতাল পৌছে, খাবার নিয়ে ঢুকে দেখি, আবার বমি করছে। ছোট ভাইকে পাঠালাম ডাক্তারের কাছে।

আব্বার কাছে আমি একা। এর মধ্যেই আরেকবার উঠল, জিজ্ঞাসার জবাবে বললো বমি করবে। নিয়ে গিয়ে করালাম, ধোয়ালাম, এনে আবার বিছানায় শোয়ালাম। পানি খাবে নাকি জিজ্ঞাসা করতে বলল খাবে। সেটাও দিলাম। ততক্ষণে কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি। চোখের সামনেই, আস্তে আস্তে জ্ঞান হারালেন, আমি তখন একা।

এরপর অনেক কিছুই হয়ে গেল।  ডাক্তারের ভাষ্যে , খারাপ লাগলেও, তাদের, খারাপ সংবাদ দিতেই হয়। আমরা যেন নেগেটিভ নিউজের জন্য প্রিপেয়ার্ড হই। 

সোমবার, আগস্ট ২৫, ২০২০ ভোর ৪ঃ৪৯। এখনো আমি একা, ICU-তে কোমায় থাকা বাবার বেড এর পাশে বসে। প্রানপনে চাচ্ছি, কেউ আমার ঘুমটা ভাঙিয়ে দিক, আমি দেখি, আমি আমার বিছানায় ঘুমাচ্ছিলাম, আব্বার পাশের ঘরে, সুস্থ, এবং নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।

একজন মানুষের হৃদয় আর কতটা কঠিন হতে পারে? নিজের চোখের সামনে সবকিছু হারাতে দেখতে পারে? কেউ কি এই দুঃস্বপ্নভরা ঘুমটা ভাঙিয়ে দিবেন প্লিজ?

Comments

Popular posts from this blog

জেনারেশন গ্যাপ

জেনারেশন এ পরিবর্তন আসে অবশ্যম্ভাবী হয়ে। এর কোন ব্যতিক্রম নাই। কেউ চাক বা না চাক এই প্রক্রিয়া চলবেই। ভাল লাগুক বা মন্দ লাগুক কেউ সময় কে থামাতে পারবে না। এর মধ্যে বিতর্ক এসে যায় ভাল পরিবর্তন আর মূল্যবোধের নিম্নগামীতা নিয়ে। কিন্তু আমি সেসব নিয়েও কথা বলছি না। আমি বলছি কারণ যুগে যুগে সব মানুষের অপ্ত বাক্য ‘ দুনিয়াটা রসাতলে গেল ’। আমার দাদা আমার দাদী কে ভীষণ ভালোবাসতেন এবং তার মৃত্যুশোকে সন্ন্যাসী হন। তিনি তখন অবশ্য ছিলেন যুব-সমাজ রসাতলে যাবার অন্যতম উদাহরণ। এখন অবিশ্বাস্য লাগতেই পারে কিন্তু তখন কেউ তাকে ছেড়ে কথা বলেনি। আমার বাবা রবীন্দ্র সঙ্গীত এর ভীষণ ভক্ত ছিল কিন্তু তার সময় এটা ছিল সঙ্গীত এর নামে অশ্লীলতা। আব্বুকেও সিনেমা হলে সিনেমা দেখাতে যাবার জন্য অসংখ্যবার শুনতে হয়েছে যুব-সমাজ রসাতলে গেল। এসব সিনেমা কে এখন আমরা আর্ট পিস এর সম্মান দেই। এখন সবার গা-জ্বালা করা একটা সর্বনাম হল ডিজুস জেনারেশন বা আধুনিক ইয়ো পোলাপান। সবার মত অনুযায়ী তাদের কোন শেকড়ই নাই এবং এরা অন্ধভাবে পশ্চিমা সভ্যতা অনুকরণ ও অনুসরণ করে। কিন্তু সময় যখন সব বদলায় তখন সময় এর সাথে যুদ্ধ করা; আমি ঠিক কিন্...

Personal notes on my Transition form Windows to Linux - Part 1 : Prolouge

Deciding to move to Open-source/Free software and Linux for everyday task is not a small decision. Especially when living in Bangladesh where almost 80% of the people still uses ASCII font based system for typing Bangla language, paying for software is a very remote idea which happens to only to the “Other people”.