Monday, October 22, 2012

উত্তপ্ত মস্তিষ্কের বিকৃত চিন্তা ও ওর্বের ক্ষোভ দমন


আগে আমাকে আমার অনেক আস্তিক বন্ধু মাঝে মাঝেই প্রশ্ন করত, আমি কেন নাস্তিক। উত্তরে আমি সব সময়ই পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিতাম, তুই কেন আস্তিক। প্রতিবারই অদের উত্তর ঘুরে ফিরে এক জায়গায় এসে দাঁড়াত, "আমার বিশ্বাস স্রষ্টা আছেন।", তখন আমিও হাসতে হাসতে বলতাম, "আমারও বিশ্বাস কেউ নেই"। কেউ কেউ এখানেই থেমে যেত, কারও উৎসাহ আরও বেশি ছিল, তারা জানতে চাইত, "কেন আমার বিশ্বাস কেউ নাই" অথবা, "কেন আমার এমন বিশ্বাস হল"। আমি তখন আবার পালটা প্রশ্ন ছুড়তাম, "তোর/তোদের কেন বিশ্বাস কেউ আছে"। অদের উত্তর হত, "জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে এসে তাদের মাঝে এই উপলব্ধি হয়েছে, যে সত্যিই কেউ আছে", অথবা, "এই মহাবিশ্ব, এই বিশাল/সুবিশাল জগৎ, এটা চলছে, এর ভাঙ্গা-গড়া, এসব দেখে তাদের উপলব্ধি হয়েছে, যে কেউ না থাকলে এটা চলত না বা সৃষ্টি হত না"। তখন আমি আবার জবাব দিতাম "জীবনের এই পর্যায়ে এসে আমার উপলব্ধি হয়েছে, যে সত্যিই কেউ নাই" অথবা, "এই মহাবিশ্ব, এই বিশাল/সুবিশাল জগৎ, এটা চলছে, এর ভাঙ্গা-গড়া, এসব দেখে আমার উপলব্ধি হয়েছে যে, এর জন্য কারও প্রয়োজন নাই"।
হয়তো তর্ক আরও কিছুক্ষণ চলত,
- "তোর কি জীবনে একবারও এটা মনে হয়নি!!!!"
- "দোস্ত বিশ্বাস কর, একবারও না"
- "একটা জিনিস কি এমনি এমনি চলতে পারে, সৃষ্টি হতে পারে??"
- "আমার বিশ্বাস পারে"

কিছুক্ষণ পর ওরা ক্ষান্ত দিত।
সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্য জানি না, কিন্তু কখনোই আমার ধর্মের বিভিন্ন দিক নিয়ে যুক্তি-তর্ক করতে হয় নাই। কখনোই আমার এসব ব্যাপার নিয়ে বেশি ঘাটতেও হয়নি।
আমি সাধারণত তর্কে যেতাম না। কারণ যুক্তির সাথে তর্ক করা যায়, কিন্তু বিশ্বাসের সাথে তর্ক চলে না। আর তর্ক শুরু হলেও তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হত না। কারণ, প্রতিবারই আমি ওদের বলতাম, "দোস্ত প্লিজ বাদ দে না, আরও অনেক বিষয় আছে কথা বলার, কেন ধর্ম নিয়েই কথা বলতে হবে"। প্রতিবার আমি আগেই হার স্বীকার করে নিতাম, "যে, আমার স্রষ্টায় বিশ্বাস নেই, আসলে এটা আমারই দোষ, থাকা উচিত ছিল। কিন্তু কি আর করা, জোর করে তো আর বিশ্বাস আনা যায় না। তাই আমি এখনও চেষ্টা চালাচ্ছি বিশ্বাস স্থাপনের, হয়তো ওদের মতন একদিন আমারও ভাগ্য খুলে যাবে, উপলব্ধি আসবে যে ঈশ্বর সত্যিই আছেন"। ওরাও ব্যাপার বুঝতে পারতো, যে আসলেই, যদি আমার বিশ্বাসই না থাকে, তবে ইবাদত/প্রার্থনা করেই বা কি লাভ, এর তো কোন ফল আমি পাব না। তার চে' বরং আমার যেন দ্রুত এই উপলব্ধি আসে তার জন্য ওরা দোয়া করাই ভালো। এবং আমার ঐ বন্ধুরা তখন তা ই করত।
যে কারণে এই ফালতু প্যাঁচাল পাড়ছি, তা হল, অনেকদিন পর আমি নিজেকে এই প্রশ্ন করে আটকে গেছি, "কেন আমি নাস্তিক"। অদের প্রশ্নের উত্তর দিছিলাম তখন ঠিকই, কিন্তু, আমার আসন অবস্থা তখন যা ছিল, এখনো তেমনই আছে, আমি জানি না কেন। আমি জানি না কিভাবে আমি নাস্তিক হলাম। কোন যুক্তি নাই, কোন কারণ নাই। আমি খামোখাই নাস্তিক। ওদের মতোই আমারও প্রচণ্ড বিশ্বাস যে ঈশ্বর বলে কেউ নাই, কিছু নাই, এই কারণেই আমি নাস্তিক। আমার বিশ্বাসই হল নাস্তিকতায়, এর জন্য আমাকে কিছু জানতে হয় নি, কিছু ভাবতে হয় নি। আর বিশ্বাসের সাথে যুদ্ধ করা চলেনা বলেই আমার বন্ধুরাও আমার সাথে এই বিষয়ে তর্ক করে মজা পেত না। ওদের বিশ্বাস ঈশ্বর আছে, যদি ওরা তেমন প্রমাণ পায় যে ঈশ্বর নাই, তবে ওরা নাস্তিক হয়ে যাবে। তেমনি, আমার বিশ্বাস ঈশ্বর নাই, আমি যদি তেমন প্রমাণ পাই, যে সত্যিই ঈশ্বর আছে, আমি আস্তিক হয়ে যাব। এর বাইরে আর কোন যুক্তির প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।
একই সাথে আরও একটা প্রশ্ন মাথাচাড়া দিচ্ছে, মানুষ কেন আস্তিক। এই প্রশ্নের উত্তর অনেক সহজ আবার অনেক কঠিন। ধর্মের মুল চালিকা শক্তি সম্ভবত ভয় ও লোভ। হয় মানুষ ভাল থাকবে কারণ সে পরকালের লোভে অথবা ঈশ্বর ভীতিতে। কিন্তু মানুষ এতো অযৌক্তিক ব্যাপারগুলো মেনে নিতে কেন এত আগ্রহী? কারণ সম্ভবত মানুষের মাঝে ভয় পেতে চাওয়ার প্রবণতা অনেক প্রবলভাবে কাজ করে। মানুষ ভয় পেতে চায়, তাই সে ভয় পায়। এটা আমাদের মজ্জাগত। মানুষের সমস্ত আবেগের মাঝে সবচেয়ে শক্তিশালী আবেগ হল ভয়। মাতৃ-জঠর থেকে বের হবার পর থেকে মানুষের ভয় পাওয়ার শুরু আর এরপর চলতেই থাকে। সব মানুষ সমান হয় না। কেউ কেউ নিজেকে দুর্বল হয়, কেউ নিজেকে দুর্বল ভাবে। তাই তারা ভায় পাওয়াতে আরও অভ্যস্ত থাকে। ধর্ম তাদের কাছে একটা আশ্রয় মাত্র। তারা ধর্মভয়ে নিজেদের ভালো রাখার চেষ্টা করে। এতে ব্যক্তিগত ভাবে আমি কোন দোষ আছে বলে মনে করি না। কেউ যদি ইচ্ছা করে দুর্বল হতে চায় বা হয় তাতে আমার কি বলার থাকতে পারে?
আমার "উনি"ও একজন নাস্তিক। তার কাছে ধর্ম হল শোষণের হাতিয়ার, মানুষের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার একটা উপায়। তার মত, সবসময়ই সক্রিয় বিরোধিতার পক্ষে। কিন্তু, আমি একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি, সেটা হল, আমার দেখা সাধারণ ধার্মিক মানুষগুলো আসলে ধর্ম সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। তাদের বিশ্বাস হল, ধর্মে কোন খারাপ কিছু নেই। আমি নিজে যখন বিভিন্ন তর্কে ছিলাম, বেশকিছু ঘটনা, যেমন, মোহাম্মদের নিজ পুত্রবধূ বিয়ে করা, অন্য ধর্মের সবাইকে ধংস করার কোরানের নির্দেশ, এসব শুনে তাদের চোখে প্রথম যা দেখেছি তা হল অবিশ্বাস। তার পর যখন তারা বুঝতে পারে, সত্যিই এসব কথা ধর্মে বলা হয়েছে, তখন তারা একে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করে, এর পক্ষে যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করে। তার আগ পর্যন্ত তারা আসলে এই ব্যাপারে মোটেও অবগত ছিল না। তাদের এই জ্ঞান প্রথম তারা পায় কোন নাস্তিকের কাছ থেকেই। কিন্তু এর পর তার ফলাফল হয় ভয়ঙ্কর। তারা এসব অনাচারের পেছনে যুক্তি দাড়া করানোর চেষ্টা চালায়। অজ্ঞানতা কখনোই অপরাধ হতে পারে না। কিন্তু জেনেশুনে ভুল কিছুকে সমর্থন করাকে স্রেফ ভুল বলে চালানো উচিত না। একটা মানুষের জন্ম থেকে লালন করা বিশ্বাস হুট করে একদিন ভেঙ্গে গেলে কখনওই যে সে ব্যাপারটা হাসিমুখে স্বীকার করে নেবে তা না। বরং, সে যতোক্ষন পারে তার বিশ্বাসকে রক্ষা করার চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার পরও কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। হয়ত, এই প্রশ্নগুলো মানে থেকে যায়, ব্যাপারটা মেনে নিতে কষ্ট হয়, কারণ ব্যাপারগুলো নিজের না তাদের পক্ষে যাচ্ছে।
ইদানীং একটা ব্যাপার বেশ দেখছি, খোমাখাতা বা ফেসবুকে একটা খেলে শুরু হয়েছে। একদল ধার্মিক, ধর্মের সমর্থনে একটা পেজ খুলে, ফটোশপে এডিট করে হোক, সত্যের অপলাপ করে হোক, আর কিছু সত্যই হোক (যা খুবই দুর্লভ, আমি একটাও পাই নাই, কারো কারো দাবি), তারা ধর্মের মহিমা প্রচার করে। আর একদল নাস্তিক অন্য একটা পেজ খুলে এর বিপক্ষে। তারপর, নাস্তিক পেজে চলে ধার্মিকদের গালাগালির বন্যা। মজাদার ব্যাপার হল, এই নাস্তিকেরা যদিও নিজেদের পেজে খুব ভদ্র ভাষায় কথা বলে, কিন্তু কোন আস্তিককে বাগে পেলে তারা কখনোই খোঁচা দেবার লোভ সামলাতে পারে না। তাদের অস্ত্র হল, ধর্মের কুৎসিত দিক গুলো, যা সাধারণ মানুষের জ্ঞানের বাইরে। আর এই ব্যাপারটা অনেকদিন ধরেই চলছে।
আমার ব্যক্তিগত অভিমত হল, সকল মত, বিশ্বাসে, এসবের সৃষ্টি হয় প্রয়োজন থেকে। আর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তা এমনিই হারিয়ে যায়। ধর্মের প্রয়োজনও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। কিছুদিন পর এ বিলুপ্তি ঘটবে। কিন্তু এই বিপ্লব একদিনে করে ফেলার চিন্তা করাটা আসলে নির্বুদ্ধিতার নামান্তর। কারণ, হাজার বছরের চর্চা একদিনে বিলুপ্ত হয় না। যতদিন এর প্রয়োজন আছে, ততদিন, হাজার খোঁচা-খুঁচি করেও কোন লাভ হবে না। আর দুর্বল চিত্তের মানুষ যতদিন আছে, ভয়, লোভ এসবের প্রয়োজনও ততদিনই আছে। কিছু দুর্বল, অন্ধকারে থাকা মানুষের বিশ্বাস ভাঙ্গতে পেরে উল্লাস করা আমার স্বভাব নয়, আর তাদের আলোর পথ দেখালাম ভেবে আত্মতুষ্টি পাওয়াও আমার কাছে নিতান্তই হাস্যকর। আবার যারা সবল, তারা বিশ্বাসের দিক থেকেও সবল, তাদের হারাতে পারার মাঝে আনন্দ আছে কিন্তু বিশ্বাসের সাথে যুক্তির তর্কে বিশ্বাস হয়তো হেরে যায় কিন্তু বদলায় না। বদলে যাওয়া একটা ধীর প্রক্রিয়া, যার গতি প্রকৃতি অনেক ধীরে ধীরেই এগোয়।
নিজেই জানি না কি সব আবোল তাবোল বলছি, কিন্তু বলছি কারণ, এই কথাগুলো শুরু করার সাথে সাথেই আমার উনি প্রবলভাবে আপত্তি জানিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন আমি একটা বাল, যে দুই নৌকায় পা দেয় সে একটা বাল। আমি নাস্তিকই না। আমি একটা বাল। আমি একটা আস্তিক। আস্তিকদের প্রতি কোনরকম সহানুভূতি থাকা উচিত না। কারণ তারা কিছু বলতে গেলেই তাদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে। আমিও আস্তিক, তাই ওদের বিরুদ্ধে একটিভিটি চললেই আমারও আঘাত লাগে, ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি। তো বুঝলাম, আমার মনের কিছু বিকৃত চিন্তা প্রকাশ করতে গিয়ে আমি একটা বড় ভুল করে ফেলেছি। ধার্মিকদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে আমি, আমার "উনা"র নাস্তিকানুভূতিতে আঘাত দিয়ে ফেলেছি এবং নাস্তিকদের প্রদর্শিত আলোর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছি। কিন্তু চিন্তা যখন করে ফেলেছি তখন তো এটা মাথায় ঢুকে গেছে, তাই ওর্বের রাগ জলে ঢেলে বিসর্জন দেবার মত, আমিও ব্লগে ঢেলে, আমার বিকৃত চিন্তাগুলো বিসর্জন দিলাম। হয়তো এখন আমি নিজেকে একজন পুর্ণাঙ্গ নাস্তিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারব, যেহেতু আমি অলরেডি আস্তিক হয়ে গেছি। আর আমার বিকৃত চিন্তার শেষ বিন্দুটি হল, হাজার বার যুক্তিতর্কে হেরে গিয়েও বিশ্বাসের অবস্থানের একচুল পরিবর্তন নাও হতে পারে। ধার্মিকদের মতোই এই ব্যাপারে উপলব্ধি আসার আগ পর্যন্ত, অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার আছে বলে মনে হয় না।

No comments:

Post a Comment