Skip to main content

বিরহী কথন

যখন ছোট ছিলাম, টেলিফোনে ক্রস-কানেকশন, রং-নাম্বারে প্রেম ব্যাপারগুলো ডাল-ভাতের মত ছিল। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় কিভাবে যে ক্রস-কানেকশন, রং নাম্বার টেলিফোনের থেকে বাঙ্গালী রোমান্টিক ব্যাপারগুলো হারিয়ে গেছে। তবে সেই সময়ের ছোঁয়া কিছুটা আমিও পেয়েছিলাম ভাবতে ভালোই লাগে।

মেট্রিক পরীক্ষার পর-পরই এমন ভাবে একজনের সাথে টেলিফোনে পরিচয় হয়। পরিচয় প্রণয়ের দিকে যাবার মতো বয়স তখনও হয় নাই। তো, সেটা সুন্দর একটা বন্ধুত্বের দিকে এগিয়েছিল। টেলিফোনে তার সাথে কথা বলতে বেশ বেগ পেতে হত। প্রথমত, তার স্বর; সুন্দর, কিন্তু এতো নিচু স্বরে কথা বলতো যে প্রায় ক্রেডল কানে ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে হত। আর দ্বিতীয়ত, সে ছিল ইংলিশ মিডিয়ামের, তার ভাষাটার অনেক শব্দই তখন আমার কাছে পরিচিত না। তার নামটাও অদ্ভুত ছিল, মারওয়া। আমি কয়েকদিন মারুয়া বলেও খেপিয়েছিলাম। একদিন পরে শুনে নিয়েছিলাম, মারওয়া, আরবের একটা পাহাড়ের নাম। হজ্বে মানুষ এই খানে দৌড়ায়। অর্থ যতদূর মনে পরছে, "স্বচ্ছ"।

তার সাথে দুটি ঘটনা আমার প্রায়ই মনে পরে,

আমার মা, আমি ফোন ধরলে বেশ বিরক্ত হত, কারণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোন আমার দখলে থাকে, তার প্রিয় কাজ ছিল, কেউ ফোন করলে আমি নেই বলা, এবং আমি বাসায় ফিরলে সেই ফোনের কথাটা বেমালুম ভুলে যাওয়া। কিন্তু একদিন আম্মাও আমাকে বলল যে, "তোকে একটা মেয়ে ফোন করেছিল, মারওয়া নামে, তুই ফিরলে ফোন দিতে বলেছে" !!! আমি অধিক শোকে প্রায় পাথর হয়ে গিয়েছিলাম, কারণ, কেউ ফোন দিয়েছে আর সেই নিউজ আমার মা আমাকে দিলো, আবার বলল ফোন ব্যাক করতে, আবার সেটা একটা মেয়ে!!! দু এক মিনিটের কথায় আমার মা-কে পটিয়ে ফেলা বিশাল একটা ব্যাপার।

আর দ্বিতীয় ঘটনা ঘটে আমাদের দেখা হবার পর। ওর নানা অসুস্থ ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "তোমার নানা কি তোমার নানীর বিরহে অসুস্থ নাকি?" এইটাই হল কাল। আমি তাকে আর কোন ভাবেই "বিরহ" ব্যাপারটা কি সেটা বুঝাতে পারি না... প্রায় দুদিন চেষ্টার পর কাছাকাছি কিছু একটা পর্যন্ত গিয়েছিলাম। কিন্তু একটা ব্যাপার তখন বেশ বুঝতে পেরেছিলাম যে, ইংরেজি ভাষায় "বিরহ" ব্যাপারটা নাই। হয়তো সভ্যতার উৎকর্ষতায় সেটা হারিয়ে গেছে, হয়তো অন্য কোন কারণে। কাছাকাছি অনেক কিছুই আছে, কিন্তু "বিরহ" শব্দটার যে বিশাল ব্যাপ্তি, সেটা সেই কাছাকাছি সবকিছু জোড়া দিয়েও পূরণ করা সম্ভব না।

আমরা হলাম, পুরনো আর নতুনের মাঝের ট্রানজিশনের প্রজন্ম। আমাদের পুরনো প্রজন্মটি আস্তে আস্তে বিদায় নিচ্ছে আর নতুন একটা প্রজন্ম এখন ঠিক চোখের সামনেই প্রাযুক্তিক উৎকর্ষতায় বাড়ছে। আমাদের নস্টালজিয়ায় ভর করে নাটক সিনেমায় এখনও টেলিফোনে প্রেম দেখাই। বিষয় গুলো অনুভব করার ক্ষমতা শুধু আমাদের প্রজন্ম পর্যন্তই ছিল। একটা সময় ঠিকই এগুলো বিদায় নিবে।

বাঙ্গালী হিসেবে আমারা অনেক ভাগ্যবান। অনেক কিছুই আমরা এখনও হারিয়ে ফেলি নাই। বিরহ ব্যাপারটা এখনও বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে আমাদের মাঝে বেচে আছে। পুরনো প্রজন্ম খুব সযত্নে যা যা আমাদের শপে দিয়ে গিয়েছিল, "বিরহ" তার মাঝে একটি। এখনও আমাদের মাঝে বেচে আছে। পুরনো সেই প্রজন্মের কাছে আমরা পেয়েছি বিরহের কবি। যার জন্মদিন ছিল গত গতকাল। আর পেয়েছিলাম বিরহের শিল্পী যিনি আজ চলে গেলেন। আমারা যেই অনুভূতিগুলো পরের প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হচ্ছি, তারা হাসি মুখে আমাদের সেই ত্রুটি মার্জনা করে, নিজেরাই সেগুলো অবলীলায় পৌঁছে দিয়েছেন নতুনের দুয়ারে, যেমন একটা সময় আমাদের কাছেও পৌঁছে দিয়েছিলেন। মৃত্যু কখনও এমন মানুষদের থামিয়ে দিতে পারে না।

আমার আজ সেই ইংলিশ মিডিয়ামের বন্ধুর কথা বেশ মনে পড়ছে। বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, বন্ধু এখনও যদি "বিরহ" বোঝার ইচ্ছে থাকে, তবে এদের কারও কাছে যাও, শুধু অর্থ-ই না, তারা তোমাকে বিরহের অনুভবটাও অবলীলায় দিয়ে দিতে পারবেন।

ধন্যবাদ জীবনানন্দ দাশ...
ধন্যবাদ মান্না দে...
আপনারা ছিলেন বলেই
এই অর্বাচীন স্বাপ্নিক, "বিরহের" মত একটা অনুভূতির সাথে আরও পরিচিত হতে পেরেছে।

আপনারা আছেন বলেই
আরও শত কোটি বাঙ্গালী "বিরহের" মত বিশাল ব্যাপ্তির অনুভূতি অনুভব করতে পারছে, এবং পারবে।

Popular posts from this blog

দুঃসময় বা দুঃস্বপ্নের সময়...

কেন যেন মনে হচ্ছে দুঃস্বপ্ন দেখছি, আর প্রচন্ড অসহায় হয়ে চাচ্ছি, কেউ আমার ঘুমটা এক ঝটকায় ভেঙ্গে দিক। দুঃস্বপ্নের শুরু মায়ের অসুস্থতা দিয়ে। এখান ওখান করে শেষ পর্যন্ত কুর্মিটোলা হাসপাতালে পৌছালাম, ইমারজেন্সি-তে ওদের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতেই মেইল এল, আম্মার COVID-19 পজিটিভ। সব ভয় ভুলে, চলে গেলাম রোগি ভরা ওয়ার্ডে, বেডে শুইয়ে দিলাম, ডায়ালাইসিস করে দিলাম। চলে আসার সময়, একবার মনে হল, এর পর আর দেখা হবে না। দু'দিন পর, ICU তে যায়গা পাওয়ায়, একটু নিশ্চিন্তে অফিসের একটা মিটিং এ জয়েন করলাম। মাঝামাঝি সময় ফোন এল, আম্মু সব চিকিৎসার বাইরে চলে গেছে, আম্মুকে নিয়ে আসতে হবে। সেদিন সেপ্টেম্বরের ৩০, ২০২০। ঈদের আর দুদিন বাকি। পরদিন বানানি কবরস্থানে মাটি চাপা দিলাম। সেই সময় প্রচন্ড বৃষ্টি, আগের দিন থেকেই স্বাভাবিকভাবেই চলছিলাম, কিন্তু কেন যেন এখন আর পারলাম না, সকল আত্মসংযমের বাধ ভেঙ্গে চুরে, বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে কান্না এল।  বৃষ্টির পানি, মুখের মাস্ক, পিপিই সব মিলে সেই চোখের পানি লুকিয়েই ছিল হয়তো, খেয়াল করা হয়নি। বা সেই অবস্থায় ও ছিলাম না।  এর পর ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন, বাসার সবার। এর মাঝেই বাবার পাতলা পায়খা...

জেনারেশন গ্যাপ

জেনারেশন এ পরিবর্তন আসে অবশ্যম্ভাবী হয়ে। এর কোন ব্যতিক্রম নাই। কেউ চাক বা না চাক এই প্রক্রিয়া চলবেই। ভাল লাগুক বা মন্দ লাগুক কেউ সময় কে থামাতে পারবে না। এর মধ্যে বিতর্ক এসে যায় ভাল পরিবর্তন আর মূল্যবোধের নিম্নগামীতা নিয়ে। কিন্তু আমি সেসব নিয়েও কথা বলছি না। আমি বলছি কারণ যুগে যুগে সব মানুষের অপ্ত বাক্য ‘ দুনিয়াটা রসাতলে গেল ’। আমার দাদা আমার দাদী কে ভীষণ ভালোবাসতেন এবং তার মৃত্যুশোকে সন্ন্যাসী হন। তিনি তখন অবশ্য ছিলেন যুব-সমাজ রসাতলে যাবার অন্যতম উদাহরণ। এখন অবিশ্বাস্য লাগতেই পারে কিন্তু তখন কেউ তাকে ছেড়ে কথা বলেনি। আমার বাবা রবীন্দ্র সঙ্গীত এর ভীষণ ভক্ত ছিল কিন্তু তার সময় এটা ছিল সঙ্গীত এর নামে অশ্লীলতা। আব্বুকেও সিনেমা হলে সিনেমা দেখাতে যাবার জন্য অসংখ্যবার শুনতে হয়েছে যুব-সমাজ রসাতলে গেল। এসব সিনেমা কে এখন আমরা আর্ট পিস এর সম্মান দেই। এখন সবার গা-জ্বালা করা একটা সর্বনাম হল ডিজুস জেনারেশন বা আধুনিক ইয়ো পোলাপান। সবার মত অনুযায়ী তাদের কোন শেকড়ই নাই এবং এরা অন্ধভাবে পশ্চিমা সভ্যতা অনুকরণ ও অনুসরণ করে। কিন্তু সময় যখন সব বদলায় তখন সময় এর সাথে যুদ্ধ করা; আমি ঠিক কিন্...

Personal notes on my Transition form Windows to Linux - Part 1 : Prolouge

Deciding to move to Open-source/Free software and Linux for everyday task is not a small decision. Especially when living in Bangladesh where almost 80% of the people still uses ASCII font based system for typing Bangla language, paying for software is a very remote idea which happens to only to the “Other people”.