গতকাল সন্ধ্যায় ডিবি অফিসে গিয়েছিলাম। ওরা ডেকে পাঠিয়েছিল, থাবার ব্যাপারে স্টেটমেন্ট দিতে। ভাবছিলাম, কি স্টেটমেন্ট দিব? কি বলব? লোকটার সম্পর্কে এরা কিছুই জানে না, চেনে না। এরা কি করে বুঝবে উনি কেমন ছিলেন? কিভাবে উনার সম্পর্কে এরা ধারনা নিবে? ফেসবুক ঘেটে, আমাদের কথা শুনে? অন্ধের হাতি দেখার মত করে?
উনার সাথে যখন প্রথম পরিচয় হয়, একটা দাওয়াতে। তখন দেখেছিলাম গোঁফ আছে, একটু বয়স্ক, দেখাচ্ছে। কাউকেই চিনি না, সবার সাথেই আগ্রহী হয়ে পরিচিত হচ্ছিলাম। আমরা নতুন কেউ সে ভাবটা উনা মধ্যে ছিল না, তাই এই কথা, সেই কথা, এভাবেই পরিচয়। ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটাও মোবাইল দিয়ে সাথে সাথেই দিলেন। এরপর আবার অন্য একটা দাওয়াতে দেখা। সেখানে আরও অনেক কথা....
এরপর দেখা সাক্ষাত শুরু হল মিরপুরেই। উনার মাধ্যমেই পরিচয় হল বিপ্লব দা'র সাথে। শুরু হল নিয়মিত আড্ডা। আপন করে নেবার প্রচণ্ড ক্ষমতা থেকেই সবাইকে আপন করে নিতেন। হাজার বার বিভিন্নভাবে ক্ষেপাতে চেয়েছি, গালাগাল করেছি উদভ্রান্ত জীবন যাপন নিয়ে, কিন্তু একতা সময় হাল ছেড়ে দিয়েছি তাকে রাগাতে না পেরে।
জীবন সম্পর্কে ছিলেন প্রচণ্ড উদাসীন, সেই কারণেই কাজ-কর্ম নিয়েও তেমন ভাবতেন না। যতক্ষণ না একবারে ঠেকে যাচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত কাজের নামও নিতেন না। বলতেন, "চলছে তো... দরকার কি?... আমার দরকার নাই তো..."।
রণদীপম-দার সাথে পরিচয় থাবার মাধ্যমে। সামনাসামনি দেখা সম্ভবত এক দিনেই। এর পর যতবার দেখা হয়েছে জ্বালিয়ে মেরেছে, তারা দুইজনই এমন সব বিষয় নিয়ে এতো গভীর আলোচনায় ডুবে যেতেন, আমাদের মাথার উপর দিবে যে। রণ-দা এমনিতে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দেন। কিন্তু থাবাকে পেলেই হয়েছে... আমরাও জ্বালাতাম থাবাকে, আপনে এত কিছু কেমনে জানেন। আর খেপাতাম, এতো হিস্ট্রির শখ, আপনে তো মিয়া সেভিং ক্রিম-ব্রাশ ইউজ করতে পারেন না।
মনে আছে, চুল-দাড়ি না কেটে পুরো জটাধারী হয়ে যাবার উপক্রম করেছিলেন। একদিন বাসায় ডাকলাম, পটিয়ে পাটিয়ে চুল-দাড়ি সব কাটিয়ে দিলাম। শেভ করতে আমি ক্রিম ইউজ করি, উনি ব্রাশ-ক্রিম ইউজ করতে পারেন না দেখে নিজেই ব্রাশ করে দিয়েছিলাম। আমাকে উনি খেপাচ্ছিলেন, তুমিই শেষ পর্যন্ত নাপিত হয়ে গেলে? গোসল করার পর একটা ফ্রেস গেঞ্জি পরানো পর মানুষটাকে চিনতে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিল। চুল দাড়ি কাটার পর, থাবাকে নিয়ে রণ-দা'র একটা মন্তব্য নিয়ে প্রায়ই থাবা, আমরা হাসাহাসি করতাম। "এমন একটা ভদ্রলোককে তো আমি থাবা বইলা অপমান করতে পারি না..."
আমার রান্না গরুর মাংস খুব পছন্দ করতেন। বারবার আমার বউকে বলতেন "পল্লব গরু রাঁধলেই আমাকে ডাকবি"। মাঝে মাঝে বাসায় রান্না থাকতো না দেখে শুধু কফি-বিস্কিট খেয়েই পার করে দিতেন ২ এক দিন। তাও রান্না করতেন না। এটা নিয়ে প্রচণ্ড গালাগাল করতাম। কোন রকম সবজীই খেতেন না। মজা করে বলতেন, "যেটা ছাগলে খায় আমি খাব!!!" এমন কি ভেজিটেবল খিচুড়ি থেকেও কুচি-কুচি করা সবজী বেছে প্লেটের এক পাশে জমাতে থাকতেন।
নাগরিকে আমারদের উৎসাহতেই লিখা শুরু করেছিলেন। পরে একটা লিখা পোস্টের পর প্রচণ্ড সমালোচনা হয়। এরপর চিটাগাং-এর আজাদি পত্রিকায় উনাকে নিয়ে একটা রিপোর্ট হয়, যে উনি উস্কানি মূলক লিখা দিচ্ছেন। এত মানুষ, এত ব্লগ থাকতে কেন এই নিউজটাই পত্রিকায় গেল সেটা আজও জানি না। তবে তখন রিকোয়েস্ট করি, লিখাটা নামান। উনি নিজে গিয়ে মুছে দিয়েছিলেন লিখা গুলো। তারপর থেকে উনি আর ব্লগে কিছু লিখেন নাই। ফেসবুকে লিখতেন। আর তার মূল বিষয় ছিল, ছাগু ফাইট।
কিছুদিন ধরে তাও বন্ধ ছিল। ছবি তোলার শখ ছিল প্রচণ্ড, আই-ফোন দিয়ে ফটোগ্রাফি করতেন। গত দু'এক মাস ধরে শুধু ফটোগ্রাফি শেয়ারই দিয়ে যাচ্ছিলেন। ফটোগ্রাফার-কে উনি বলতেন ফটো-গফুর, নিজেকে থাবা-গফুর। আমরাও যা দেখতাম সেটা নিয়েই বলতাম, "ঐ যে থাবা, থাবা, থাবা... এখন একটা থাবা তুলেন..." উনি হাসতেন।
এমন আরও হাজার খুঁটিনাটি হাজার কথা জমে আছে। কিছুদিন আগে উনি একটা কাজ পেয়েছিলেন। রাতে জেগে জেগে ফেসবুকের পাশাপাশি ঐ কাজটাও করতেন। ১৫ তারিখ সাড়ে ৪টার দিকে ফোন দিলেন,
-আসবি?
কোথায় জিজ্ঞাসা করতে জানালেন, নতুন রাস্তায় যাবেন। প্রশ্ন করলাম শাহবাগ যাবেন না? উনি বললেন কাজ করতে হবে, শাহবাগ গেলে আর করা হবে না। আমরা দু-একবার ঝুলোঝুলি করে রওনা দিয়ে দিলাম।
মনে মনে গালি দিচ্ছিলাম, কেন আজকেই তাকে কাজ করতে হবে। কেউ না থাকলে এমনিতেই জমে না, তাই শাহবাগেও মন টিকলো না। থাবাও নেই যে গল্প করব, ঠিক করলাম, বিপ্লব-দার বাসা হয়ে মিরপুর যাই। ও খান থেকে বের হবার আগ মুহূর্তে গালিব বিপ্লব-দাকে ফোন দিল। তাপর থেকে সবকিছুই কেমন যেন ঝাপসা, ঘোলাটে।
এটাও ভেবেছি, যে ঐ দিন যদি নতুন রাস্তা যেতাম তাহলে হয়তো আমরাও...
আবার ভেবেছি, যদি যেতাম তাহলে হয়তো লোকটা বেচে যেত... কিন্তু ভাবনা গুলোও প্রচণ্ড ঝাপসা, ঘোলাটে।
টিভি দেখছি, পেপার দেখছি, ফেসবুক দেখছি, ব্লগ দেখছি। মাঝেমাঝেই একটা ছবি টিভিতে দেখাচ্ছিল, থাবা একটা টেবিলে, সাদা গেঞ্জি পরা, হাসছে। প্রতিবার মনে হচ্ছিল ঐ তো থাবা! মরে নাই!! সব প্রোপাগান্ডা!! এক্ষুনি কথা বলে উঠবে!!!
মানুষের সাক্ষাতকার দেখছি, বক্তব্য দেখছি। ব্লগে, ফেসবুকে, টিভিতে...
আমরা উনাকে থাবা বলেই ডাকতাম। এমনকি রণ-দা সহ। শুধু তার ভাই দুটো ডাকতো শুভ ভাই। রাজীব নামটা খুব অচেনা লাগে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, ওরা অন্য কারও কথা বলছে।
হয়তো আসলেই ওরা অন্য কারও কথা বলছে। ওদের কাছে রাজীব ভাই একজন ফেলো ব্লগার/ফেসবুকার, দু একদিন কথা হয়েছে। আমাদের কাছে উনি থাবা, ফ্যামিলি। ওদের কথা শুনে প্রচন্ড কষ্ট হয়। ওরা কোনদিন অনুভব করবে না, আমরা কোন কষ্ট নিয়ে লিখছি, আমরা কেন সাবার মত সাথে সাথেই প্রতিবাদে ফেটে পড়ছি না। কোন কষ্টের ধাক্কা সামলাতে আমরা সবাই হঠাৎ করেই নিশ্চুপ হয়ে গেছি।
থাবাকে নিয়ে রণ-দা'র একটা লিখা পড়লাম। চোখ ভিজে যায়...
আর কোন দিন বিপ্লবদার বাসায় গিয়ে দিদিকে নালিশ করতে পারবো না, দিদি, রান্না ঘরে, থাবা সব ধাবা দিয়ে খেয়ে নিচ্ছে..
আর কোন দিন রণ-দা'র কথার সূত্র ধরে তাকে ক্ষেপাতে পারব না...
আর কোন দিন তার কলা খাওয়া নিয়ে কলা বাবা বলে ক্ষেপাতে পারব না...
আর কোন দিন তাকে বলতে পারবনা আপনে একটা খাটাশ...
আর কোন দিন বলতে পারব না "ধুর মিয়া, আপনে তো ব্রাশই ইউজ করেন নাই, আপনে আমার চে বড় কেমনে???"
আর কোনদিন কোন কিছু দেখেই চেঁচিয়ে উঠতে পারব না, "থাবা... ঐ যে থাবা..., থাবা তুলেন...."
বেচে থাকলে হয়তো জীবনের নিয়মে একটা সময় দুরে চলে যেতাম, ভুলে যেতাম
আর কোন দিন লোকটাকে ভুলতেও পারব না...
No comments:
Post a Comment