Friday, October 25, 2013

বিরহী কথন

যখন ছোট ছিলাম, টেলিফোনে ক্রস-কানেকশন, রং-নাম্বারে প্রেম ব্যাপারগুলো ডাল-ভাতের মত ছিল। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় কিভাবে যে ক্রস-কানেকশন, রং নাম্বার টেলিফোনের থেকে বাঙ্গালী রোমান্টিক ব্যাপারগুলো হারিয়ে গেছে। তবে সেই সময়ের ছোঁয়া কিছুটা আমিও পেয়েছিলাম ভাবতে ভালোই লাগে।

মেট্রিক পরীক্ষার পর-পরই এমন ভাবে একজনের সাথে টেলিফোনে পরিচয় হয়। পরিচয় প্রণয়ের দিকে যাবার মতো বয়স তখনও হয় নাই। তো, সেটা সুন্দর একটা বন্ধুত্বের দিকে এগিয়েছিল। টেলিফোনে তার সাথে কথা বলতে বেশ বেগ পেতে হত। প্রথমত, তার স্বর; সুন্দর, কিন্তু এতো নিচু স্বরে কথা বলতো যে প্রায় ক্রেডল কানে ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে হত। আর দ্বিতীয়ত, সে ছিল ইংলিশ মিডিয়ামের, তার ভাষাটার অনেক শব্দই তখন আমার কাছে পরিচিত না। তার নামটাও অদ্ভুত ছিল, মারওয়া। আমি কয়েকদিন মারুয়া বলেও খেপিয়েছিলাম। একদিন পরে শুনে নিয়েছিলাম, মারওয়া, আরবের একটা পাহাড়ের নাম। হজ্বে মানুষ এই খানে দৌড়ায়। অর্থ যতদূর মনে পরছে, "স্বচ্ছ"।

তার সাথে দুটি ঘটনা আমার প্রায়ই মনে পরে,

আমার মা, আমি ফোন ধরলে বেশ বিরক্ত হত, কারণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোন আমার দখলে থাকে, তার প্রিয় কাজ ছিল, কেউ ফোন করলে আমি নেই বলা, এবং আমি বাসায় ফিরলে সেই ফোনের কথাটা বেমালুম ভুলে যাওয়া। কিন্তু একদিন আম্মাও আমাকে বলল যে, "তোকে একটা মেয়ে ফোন করেছিল, মারওয়া নামে, তুই ফিরলে ফোন দিতে বলেছে" !!! আমি অধিক শোকে প্রায় পাথর হয়ে গিয়েছিলাম, কারণ, কেউ ফোন দিয়েছে আর সেই নিউজ আমার মা আমাকে দিলো, আবার বলল ফোন ব্যাক করতে, আবার সেটা একটা মেয়ে!!! দু এক মিনিটের কথায় আমার মা-কে পটিয়ে ফেলা বিশাল একটা ব্যাপার।

আর দ্বিতীয় ঘটনা ঘটে আমাদের দেখা হবার পর। ওর নানা অসুস্থ ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "তোমার নানা কি তোমার নানীর বিরহে অসুস্থ নাকি?" এইটাই হল কাল। আমি তাকে আর কোন ভাবেই "বিরহ" ব্যাপারটা কি সেটা বুঝাতে পারি না... প্রায় দুদিন চেষ্টার পর কাছাকাছি কিছু একটা পর্যন্ত গিয়েছিলাম। কিন্তু একটা ব্যাপার তখন বেশ বুঝতে পেরেছিলাম যে, ইংরেজি ভাষায় "বিরহ" ব্যাপারটা নাই। হয়তো সভ্যতার উৎকর্ষতায় সেটা হারিয়ে গেছে, হয়তো অন্য কোন কারণে। কাছাকাছি অনেক কিছুই আছে, কিন্তু "বিরহ" শব্দটার যে বিশাল ব্যাপ্তি, সেটা সেই কাছাকাছি সবকিছু জোড়া দিয়েও পূরণ করা সম্ভব না।

আমরা হলাম, পুরনো আর নতুনের মাঝের ট্রানজিশনের প্রজন্ম। আমাদের পুরনো প্রজন্মটি আস্তে আস্তে বিদায় নিচ্ছে আর নতুন একটা প্রজন্ম এখন ঠিক চোখের সামনেই প্রাযুক্তিক উৎকর্ষতায় বাড়ছে। আমাদের নস্টালজিয়ায় ভর করে নাটক সিনেমায় এখনও টেলিফোনে প্রেম দেখাই। বিষয় গুলো অনুভব করার ক্ষমতা শুধু আমাদের প্রজন্ম পর্যন্তই ছিল। একটা সময় ঠিকই এগুলো বিদায় নিবে।

বাঙ্গালী হিসেবে আমারা অনেক ভাগ্যবান। অনেক কিছুই আমরা এখনও হারিয়ে ফেলি নাই। বিরহ ব্যাপারটা এখনও বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে আমাদের মাঝে বেচে আছে। পুরনো প্রজন্ম খুব সযত্নে যা যা আমাদের শপে দিয়ে গিয়েছিল, "বিরহ" তার মাঝে একটি। এখনও আমাদের মাঝে বেচে আছে। পুরনো সেই প্রজন্মের কাছে আমরা পেয়েছি বিরহের কবি। যার জন্মদিন ছিল গত গতকাল। আর পেয়েছিলাম বিরহের শিল্পী যিনি আজ চলে গেলেন। আমারা যেই অনুভূতিগুলো পরের প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হচ্ছি, তারা হাসি মুখে আমাদের সেই ত্রুটি মার্জনা করে, নিজেরাই সেগুলো অবলীলায় পৌঁছে দিয়েছেন নতুনের দুয়ারে, যেমন একটা সময় আমাদের কাছেও পৌঁছে দিয়েছিলেন। মৃত্যু কখনও এমন মানুষদের থামিয়ে দিতে পারে না।

আমার আজ সেই ইংলিশ মিডিয়ামের বন্ধুর কথা বেশ মনে পড়ছে। বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, বন্ধু এখনও যদি "বিরহ" বোঝার ইচ্ছে থাকে, তবে এদের কারও কাছে যাও, শুধু অর্থ-ই না, তারা তোমাকে বিরহের অনুভবটাও অবলীলায় দিয়ে দিতে পারবেন।

ধন্যবাদ জীবনানন্দ দাশ...
ধন্যবাদ মান্না দে...
আপনারা ছিলেন বলেই
এই অর্বাচীন স্বাপ্নিক, "বিরহের" মত একটা অনুভূতির সাথে আরও পরিচিত হতে পেরেছে।

আপনারা আছেন বলেই
আরও শত কোটি বাঙ্গালী "বিরহের" মত বিশাল ব্যাপ্তির অনুভূতি অনুভব করতে পারছে, এবং পারবে।